গল্পঃ দ্বান্দ্বিক

Half of me is beautiful
but you were never sure which half.
— Ruth Feldman, “Lilith”

১.
— মাঝে মাঝে তোমাকে ঠিক বুঝতে পারিনা।
মইনুলের কণ্ঠ নির্বিকার,
— এমন হলে, মাঝে মাঝে, বুঝার চেষ্টা না করাই তো ভালো, তাই না!

সোমা কথা খুঁজে পায় না, খুঁজার চেষ্টা করে এমনও নয়, কথা খুঁজা বা কথার পিঠে প্রশ্ন করার সময় এটা নয়, কোনো কথা না বলে মাইনুলের ডান বাহুর ওপর ঘাড় রেখে শোয়। এভাবে শুতে প্রথম প্রথম বেশ অস্বস্তি হত, ঘাড়ে ব্যথাও হত, এখন আর হয় না।

শোবার ঘর, নীল আলোর ডিম লাইট জ্বলছে, মৃদু আলো আর অপাপবিদ্ধ অন্ধকার – একের ওপর অন্যের অধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধে কেউ নিরঙ্কুশ জয়লাভে সমর্থ হয়নি, ছোপ ছোপ আবছায়া, দু’বছরের অভ্যস্ততায় দু’জনের চোখে সয়ে গেছে, চার দেয়ালে বন্দী বিবর্ণ আবছায়ায় দু’জন দু’জনকে স্পষ্ট দেখতে পায়, চোখের অতি ক্ষুদ্রতম ক্ষণের অভিব্যক্তি আর মুখের রেখার সামান্যতম পরিবর্তনও চোখ এড়ায় না, হয়তো এই অবছায়াতেই দু’জন দু’জনকে সবচে ভালো দেখে- আড়ালহীন, আড়ম্বরহীন।

২.
প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ, ম্যাচ ফিক্সিং ওপেন সিক্রেট ঘটনা, ক্লাবের কর্তারা বলেছিল, ‘ম্যাচটা ছেড়ে দিও, মইনুল। আজ ত্রিশ ওভারের ভেতর অল আউট হতে হবে।’ ক্রিজে মইনুলের ব্যাট এমনভাবে ঝলসে উঠলো, আম্পায়ার ওকে এলবিডব্লু আউট বা স্ট্রাইকিং এন্ডের ব্যাটার ভুল কল দিয়ে রান আউট করার সুযোগ পেলো না, লো স্কোরিং ওয়ান ডে ম্যাচে ২৮ ওভারের মধ্যে জয় নির্ধারিত হয়ে গেল।

পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি উচ্চতার এথলেটিক ফিগার আর শান্ত মুখায়বের এটাকিং পেস বলার মইনুল, ফোর্থ বা ফিফথ ডাউনে নির্ভরযোগ্য স্টাইলিশ ব্যাটার। মাঠের বাইরে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যাওয়া ম্যাচগুলোতে মইনুল বিপজ্জনক খেলোয়াড়, যতবার নির্ভর করা হয়েছে, ফলাফল উলটে গেছে। এ নিয়ে ক্লাব আর বোর্ডের ক’জন কর্তার সাথে মইনুলের সম্পর্ক তিক্ত থেকে তিক্ততর দিকে গড়াচ্ছিল। তবু আশা ছিলো উইকেট ও রানের হিসাবে, দক্ষতা আর যোগ্যতার পরিমাপে জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পাবে, পলিটিক্যাল ব্যাকিং না থাকায় প্রাথমিক ট্রায়ালেও ডাক পায়নি।

ক্রিকেট ভদ্র লোকের খেলা, ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতিটা চলে, ভদ্রলোকরাই করে, তা মোটেও ভদ্রলোকের রাজনীতি নয়- এ ধ্রুব সত্যটা প্রায় প্রতিটি খেলোয়াড় জানে। মইনুল এ রাজনীতির অংশ হতে চায়নি, প্রতিপক্ষও হতে চায়নি, ও বিপ্লবী নয়, নিজের প্রতি ঘটা অবিচারটা কষ্ট হলেও মেনে নিয়ে, মাস্টার্স শেষ করার আগেই বল, ব্যাট আর প্যাড কফিনে বন্দী করে ক্রিকেটের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ইতি ঘটায়।

মাস্টার্স শেষে চাকরীর জন্য মইনুলকে অপেক্ষা করতে হয়নি, দু’বছরের মধ্যে নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছিল। এমন হিরার টুকরা ছেলেকে আর একা রাখে যায় না, কোথায় কোন মেয়ের পাল্লায় পরে, কোন মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তোলে, এসব দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত পৃথিবীর সকল মায়ের মত ‘যা দিনকাল পড়েছে’ দর্শনে মইনুলের মা’ও সমান বিশ্বাসী, ছেলে কিছু ঘটিয়ে ফেলার আগেই তিনি পাত্রী অনুসন্ধানে ব্যস্ত হলেন।

৩.
প্রতিটি সুখী বাঙালি পরিবারই কি মাতৃপ্রধান, সুখী পরিবারগুলোর প্রশাসনিক প্রধান কি বাবা এবং নির্বাহী প্রধান মা- না, এমন কোনো পরিসংখ্যান বা গবেষণাপত্রের খোঁজ মইনুল পায়নি, তবে এ সূত্র মেনেই ওদের পরিবার আদর্শ সুখী পরিবার। নামজাদা গ্রুপ অব কোম্পানিতে বাবা প্রবেশ করেছিলেন সহকারী হিসাব রক্ষক পদে, এখন চিফ একাউন্টেন্ট, অফিসে হিসেব পত্তর মিলান আর বাড়িতে ইংরেজি থ্রিলার পড়েন, সংসার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন মা। বাবা সপ্তাহে দু’দিন বাজার করেন, সেও মা’র দেয়া লিস্টি মেনে, একটুও এদিক ওদিক হবার জো নেই।

মা’র মাথায় সবসময় ঘোমটা থাকে, পান খাওয়া লালচে ঠোঁটে লেগে থাকে এক চিলতে স্মিত হাসি, প্রশ্রয়ের হাসি নয়, এ হাসি অপরের মাঝে সংক্রমিত হয় না, এ হাসি মোলায়েম হয়েও বুকের গভীরে বিদ্ধ করে। মা হাসিমুখে নিপুণ দক্ষতায় সংসার চালান, নিয়ন্ত্রণের কঠোরতাটা খালি চোখে ধরা প্রায় পড়েই না, কিন্তু এটাও সত্য পরিবারের কারো পক্ষেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়। তিন বছর আগের কথা, বড় ফুপু খুব করে চাইছিলেন মইনুলের ছোট বোন মিতুকে ছেলের বউ করতে, বোনের আবদারে ভায়ের মানে বাবার আপত্তি ছিল না, আপত্তি ছিলো মা’র। কিন্তু সে কথা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেন নাই, এমনভাবে পরিস্থিতি সামাল দিলেন, বড় ফুপু নিজেই আবদার থেকে সরে এলেন, মিতুর বিয়েতে ফুপা হাসি মুখে উকিল পর্যন্ত দিলেন।

এক মাত্র ছেলের জন্য মা পাত্রী দেখতে শুরু করেছিলেন আগেই, অবশ্য একদিন, সাপ্তাহিক ছুটির এক দুপুরে, খাবার টেবিলে এলেবেলে কথার মাঝে, বাবার সামনে হঠাৎ জানতে চাইলেন, ‘তোর কোনো পছন্দ টছন্দ নেই তো! থাকলে বলতে পারিস, বাবা।’ মইনুল ভাত খাওয়া থামিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে মা’র চোখে তাকায়, বলে, ‘তেমন কেউ থাকলে তো তুমি জানতে, মা। আমি না জানালেও খুঁজে খুঁজে ঠিক বের করে ফেলতে, কি ফেলতে না!’ মা’র হাসি বিস্তৃত হয়, পরম মমতায় রুই মাছের আরেকটা টুকরো মইনুলের প্লেটে তুলে দেন, ‘খা বাবা, নদীর মাছ, কড়া করে ভেজে রান্না করেছি।’

শুধু যে মা’ই পাত্রী দেখছেন এমন নয়, আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধবরাও পিছিয়ে নেই, অপার উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে যে যার অবস্থান হতে যোগ্য পাত্রীর অনুসন্ধানে এগিয়ে এসেছে। একদিন বন্ধু অপু মা’কে বলল, ‘চাচী, একবার সোমাকে দেখেন। মইনুলের সাথে মানাবে ভালো, বেশ সুন্দরী, হাইট পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি।’

‘বেশ সুন্দরী’ এবং ‘হাইট পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি’ – মা’র কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, এ তথ্যই সোমার প্রতি মা’কে আকৃষ্ট করলো। তিনি মইনুলের সাথে এমন একজনকে জুড়ে দিতে চান, যে সকল দিক দিয়ে মানানসই বা চলনসই হবে না, হবে অদ্বিতীয়া।

৪.
নিজের রূপ সম্পর্কে সোমার সন্দেহ ছিলো না, আর দশজন মেয়ের সাথে দাঁড়ালে ও বিশেষ থেকে বিশেষতর হয়ে ওঠে, এ তার জানা। অনার্স ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত প্রেমিকের অভাব ছিলো না, সব একতরফা প্রেমিক, ও পাত্তা টাত্তা দেয়নি। সেকেন্ড ইয়ার থেকে কিভাবে যেনো রটতে শুরু করেছিলো সোমা কারো সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ, একতরফা প্রেমিকরা সব আশা ত্যাগ করে দূরে সরে গেল, এক একটা দিন সোমার খুব প্রেম পেত, এক তরফা প্রেমিকদের জন্য মায়া হত, কোনো এক অচেনা প্রেমিকের জন্য বুকে শূন্যতা বোধ করতো- ওই বোধ করা পর্যন্তই।

সোমা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার অপেক্ষা করছে, তখন হঠাৎ করেই সম্বন্ধটা এলো। পাত্র কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে মাঝারি পদে চাকরি করে, হ্যান্ডসাম, বাজে অভ্যাস নেই, ক্রিকেট খেলতো এক সময়, লেনা-দেনা নেই, পরিবারও ছোট- সম্বন্ধ স্থাপনে অরাজী হওয়ার বা প্রত্যাখানের কোনো গ্রহনযোগ্য যুক্তি পাওয়া গেলো না। সোমার বাবা সহজেই রাজী হলেন, মা মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন, ‘ফাইনাল পরীক্ষাটা আগে শেষ হোক, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে’, আপত্তি টিকলো না।

ঝামেলা ছাড়া বিয়ে বাঙালির কালচারে নেই, এ বিয়েও ব্যতিক্রম নয়, মইনুলের মা’র কাঁধে চেপে উপস্থিত হলো ঝামেলা, তিনি বিয়ের জন্য এমন তাড়াহুড়ো শুরু করলেন, সোমার ছোট মামা বললেন, ‘এতো তাড়াহুড়ো কেনো! ছেলে কি ড্রাগ এডিক্ট না অস্ত্র মামলার আসামী!’ বিয়ে ভাঙে ভাঙে অবস্থা, সোমার বাবা শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করলেন।

মইনুলের সাথে বিয়ের কথাবার্তা যখন চলছে, সোমার কোনো বক্তব্য ছিলো না, বাবা-মা’র ওপর সব ভার ছেড়ে দিয়েছিলো, মইনুলকে দেখার পর, কথা বলার পর, মনে হয়েছে এই মানুষটার সাথে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব, কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

মইনুল আর সোমার সংসার জুড়ে উপছানো সুখ, দু’বছর চলছে, বড় ধরণের ঝগড়া হয়নি, মন খারাপের কারণ ঘটেনি। সোমা ক’বার চেষ্টা করেছে মইনুল রাগাতে, ঝগড়া করতে, মইনুল হাসতে হাসতে বলেছে, ‘আচ্ছা রাগলাম, তুমি এবার ঝগড়া শুরু করো।’ এভাবে কি ঝগড়া শুরু করা যায়, সোমা ওই চেষ্টা বাদ দিয়েছে। মইনুল যে যত্ম নেয়, ওর ইচ্ছার গুরুত্ব দেয়, ভালবাসে, সোমা বেশ উপভোগ করে, কড়ায় গণ্ডায় ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করে।

এক একটা দিন, মইনুলের যে কি হয়, সোমা ঠিক বুঝতে পারে না, কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে, মইনুল কখনো কখনো প্রশ্নের উত্তর দেয়, এমন উত্তর দেয় যার কোনো অর্থ হয় না, বেশীর ভাগ সময়ই পাশ কাটিয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্নটার মুখোমুখি হলেই, মাইনুলের চোখের অভিব্যক্তি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে, আবছায়াতেও সোমার চোখ এড়ায় না।

৫.
ঘর জুড়ে নরম নীল আলো এবং অন্ধকার, দুইয়ের অবিশুদ্ধ মিশ্রণে বিকশিত আবছায়া বিবসনকে রহস্যময় করে তোলে, বসনকে শৈল্পিক। যুগল হাওয়ায় অজস্র প্রজাপতি উড়ানো শেষে, ফুলকি আঁকা পাখায় পাখায় নিবিড়তম পর্যটন শেষে, পরস্পরের পালকে পালকে ওমের সঞ্চারণ শেষে,
কোমল বাঁকের নদীকে কাচবর্ণ স্বচ্ছ রাতপোশাকে বন্দী করতে করতে মইনুলের চোখে চোখ রাখে সোমা,
— মাঝে মাঝে সত্যিই তোমাকে ঠিক বুঝতে পারিনা, সত্যিই বুঝতে পারি না।
মাইনুল একটা সিগারেট ধরায়, লম্বা টান দেয়, অপর হাতে সোমার বুকের খাঁজে বিলি কাটতে কাটতে বলে,
— কি বুঝতে পারো না।

সোমা বিস্মিত, এই প্রথম জানতে চাইছে মইনুল, বিস্ময় গোপন না করে বলে,
— তুমি.. মানে তুমি মাঝে মাঝে কেমন বদলে যাও, পশুর মত, ওই সময়টাতে তোমার স্পর্শে আদর নয়, ভর করে পাশবিক রাগ আর জান্তব ঘৃণা.. তোমার চোখে.. তোমার চোখে তাকাতে ভীষণ ভয় হয়..

‘হু’ বলে সিগারেটে আরেকটা টান দেয় মইনুল, সোমারও ত্বরা নেই, মইনুলের চোখে একের পর এক অবিভ্যক্তির দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ্য করে যায়।

মইনুলের মস্তিষ্কে বা মনের স্ক্রিনে ভাসছে একের পর এক দৃশ্য, ছায়াছবির ট্রেলার যেনো, এক দুপুর, উদোম শরীরে মইনুল ঘুমোচ্ছে, মা ডেকে তুললেন, শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার বুকে এমন নীল দাগ এলো কোথা থেকে?’ মইনুলের উত্তর, ‘পোকার কামড় হবে হয় তো।’ মা বললেন, ‘পোকা দেখছি পিঠে আঁচড়ও কেটেছে, বিষাক্ত পোকা,ওষুধ লাগাও।’

‘বিষাক্ত পোকা’ কথাটার প্রতিবাদ করে মইনুল বলতে চাইলো, ‘বিষাক্ত পোকা নয় মা, নীল পোকাটার নাম দোলা’, মা’র শীতল চোখে তাকিয়ে বলার সাহস হলো না, অথচ দোলার জন্য জীবন বাজি রাখার প্রতিজ্ঞা ছিল।
পোকার দৃশ্য দ্রবীভূত হয়ে গেলো মহম্মদপুরের এক রুমের ফ্ল্যাটে, গোপন সংসার, দোলার সাথে গভীর প্রেম, উন্মাদনা, খুনসুটি, ঝগড়া, এক দিন দেখা না হলেই শ্বাসকষ্টের শুরু, কাজী অফিসে গোপন বিয়ে, প্রিমিয়ার লীগ আর বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলার কারণে আয় রোজগার নেহায়েত মন্দ নয়, সপ্তাহে এক কি দুই দিন ভার্সিটি ফাঁকি, মহম্মদপুরের ফ্ল্যাটে সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজেদের মত কাটানো, এক একটা দিন পোকা পোকা খেলা, মাস্টার্স শেষে মা’কে ম্যানেজ করে দোলাকে ঘরে তোলার স্বপ্ন।

স্বপ্নের দৃশ্য মুছে দেয় ধেয়ে আসা ঢেউ, শুরু হয় নতুন দৃশ্য, প্রবল ঘোর, দোলাময় দিনকাল, ঘরে সাবধানতা, তবু পাঁচ মাসে বার দু’য়েক মা’র চোখে দৃশ্যমান হয় পোকার কামড়, জুম হয়ে আসে মা’র চোখ, দু’বারই মনের ভেতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন মা’র এমন তীক্ষ্ম দৃষ্টি, মুহুর্তের জন্য দাগের দিক হতে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া, চোখে চোখ রেখে উনার শীতল হাসি, কিছুই না বলা, মা’র আচরণে মনের ভেতর সংঘবদ্ধ প্রবল ভয় আর আনন্দ অশেষ।

উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণে ঢেকে যায় প্রবল ভয় আর আনন্দ অশেষ, মা’র আবদার — ‘দোলাকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আয়, বাবা’, বিব্রত মইনুল, আনন্দে শ্বাসকষ্টের শুরু, আকাশ অনেক নিচে নেমে এসেছে, ঘরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে মেঘ, কিছু না বলে ‘হ্যা’ সূচক মাথা নাড়ানো, বিকেলে কথাটা জানাতেই দোলার করুণ স্বর, ‘সত্যিই তোমার মা আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছেন! কিন্তু উনি তো… উনি তো…’ কথা শেষ না করে দোলার থেমে যাওয়া।

দৃশ্যের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জরুরী বিভাগ, উদ্বেগ আর আহাজারিতে ঠাসাঠাসি, দম বন্ধ হয়ে আসছে, এক পাশে স্ট্রেচারে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে দোলা, রক্তে-মাংসে মাখামাখি, আধ চা চামুচের মত মাথার ঘিলু চুইয়ে পড়েছে স্ট্রেচারে, যে মগজে দোলা সর্বস্ব দিয়ে ধারণ করেছিল মইনুলকে, ওই মগজের অনেকটা ততক্ষণে নীলক্ষেত মোড়ে মিশে গেছে, ঘাতক গাড়ির চাকায় পিষ্ট হতে হতে শুকিয়ে ধুলো হয়ে গেছে। দোলার নিথর হাতটা মুঠোয় পুরার পর, কি আশ্চর্য, মইনুলের চোখে ভেসে উঠে মা’র তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর স্বভাবসুলভ স্মিত হাসি মাখানো নির্ভার মুখাবয়ব।

মইনুলের মস্তিষ্ক বা মনের স্ক্রিনে আড়াই মিনিটের শো শেষ হয়, ওর জানা নেই কে দোলাকে খুন করেছিলো, কিভাবে খুন করেছিলো, তবে নিশ্চিত জানে কে খুন করিয়েছিল, ও নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করে।
এক একটা সময় মইনুলের অজান্তে মস্তিষ্ক বা মনের ভেতর স্লাইড শো শুরু হয়ে যায়, মনে ভর করে বিকট আক্রোশ, এ আক্রোশের জন্ম বীভৎস অন্ধকারে। মর্মঘাতী আক্রোশে নিমজ্জনের সময়গুলোতে সোমাকেও দোলার খুনি মনে হয়, আঙুলে পিষে পিপঁড়া মারার মত সোমাকে পিষে পিষে খুন করতে ইচ্ছে করে।

ঘরে ছোপ ছোপ অন্ধকার, আলোর প্রতি অন্ধকারের বা অন্ধকারের প্রতি আলোর আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধে এখনও জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়নি, দোলার কথা জানাবে কি জানাবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মইনুল, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে মইনুলের চোখে তাকিয়ে আছে সোমা।

.
দ্বান্দ্বিক| গল্প
২৭অক্টোবর২০২১

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
গল্পঃ দ্বান্দ্বিক, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ৩১-১০-২০২১ | ৯:১৮ |

    অসাধারণ গল্প উপহার। বিশেষ শুভ কামনা মি. আবু সাঈদ আহমেদ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. ফয়জুল মহী : ৩১-১০-২০২১ | ২২:৪৮ |

    মনোমুগ্ধকর প্রকাশ

    GD Star Rating
    loading...